দূঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দূঃখ কি | সংবাদ চিত্র

দূঃখে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার দূঃখ কি | সংবাদ চিত্র

আবদুল হামিদ মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক, টেকনাফ থেকে ।। কবি দাউদ হায়দার তার ”জন্মই আমার আজন্ম পাপ” কবিতায় মানুষের জম্মকে পাপ বলে উল্লেখ করলে ও প্রতিটি মানুষই চায় একটি সুন্দর সুস্থ, সুখী ও আনন্দময় জীবন। আত্ন নির্ভরশীল তথা পরমুখাপেখী না হয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাপন করা প্রতিটি মানুষের কাম্য। কিন্তু অনেকে জন্মগতভাবে কিংবা জন্মের পরে বিভিন্ন কারনে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে।

একজন প্রতিবন্ধী তার প্রতিবন্ধীত্বের কারনে যতটা না কষ্ট পায় তার চেয়ে অনেক বেশী কষ্ট পায় সমাজ ও মানুষের অবজ্ঞা অবহেলা আর সহযোগিতার অভাবে। সকল পরিবারে এরা হয় অবাঞ্চিত। তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বা মতামতের প্রতি তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। আর্থিক সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতার কারনে প্রতিবন্ধীর যথাযথ পরিচর্যা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সব সময সম্ভব হয়েও উঠে না। এ ছাড়া ও রয়েছে নানা কু-সংস্কার। প্রতিবন্ধীরা যে সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা পেলে এরাও যে অসীম সম্ভাবনা ও প্রতিভার স্ফুরন ঘটাতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরন প্রতিবন্ধী শেখ রহমানকে ঘিরে। 
নদী ও সাগর বেষ্টিত কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের ছোট হাবিবপাড়া গ্রামটি সুন্দর শ্যামলিমায় ঘেরা। বাংলাদেশের অন্যান্য জনপদ থেকে একটু বিচ্ছিন্ন। অথচ এগিয়ে চলেছে একই তালে, একই গতিতে। 
প্রাকৃতিক ও বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের আগমনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠি আজ দুর্দশাগ্রস্থ। প্রায় প্রতিবছরই কোন না কোন দুর্যোগ আঘাত হানে। 
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ছোট হাবিবপাড়া গ্রামে এক দিনমজুর পরিবারে তার জন্ম। তার বাবা রেজাউল করিম একজন দিন মজুর ও মা আয়েশা খাতুন গৃহিনী। পরিবারে ৫ ভাই বোনের মধ্যে সে তৃতীয়।
শেখ রহমান মার্তৃগর্ভে থাকাকালীন তার মা সংসারের যাবতীয় কাজ করতো। একদিন বাড়ির উঠোনে পড়ে যাওয়ার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। গ্রাম্য ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হলে ডাক্তার জ্বর ও ব্যথার ঔষধ সেবন করে। স্বাভাবিকভাবেই তার জন্ম হয়। জন্মের ৩ মাস পর প্রচন্ড হাঁড় কাঁপানো জ্বরে বেশ ভূগেছিল।
দিন যতই বাড়তে থাকে শেখ রহমান ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। এক বৎসরে যখন পা রাখল তখন তার অন্যান্য সম বয়সী বাচ্চাদের মত কথা বলতে ও শুনতে না পারা দেখে তার মা-বাবার মনে ভয় ঢুকল। এলাকার মুরুব্বীদের পরামর্শ নিয়ে ঢাকা, কক্সবাজার মেডিকেল  হাসপাতাল সহ বিভিন্ন কবিরাজ ও ঝাড়- ফুকের মাধ্যমে কোন আরোগ্য না পেয়ে নাক, কাল ও গলার বিশেষজ্জ জনৈক ডাক্তারের মুখে তার কথা বলা ও না শোনার কথা জেনে তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। তার জন্ম শুধু কু-কর্মের জন্য নয় বরং তার মা ও বাবা বুঝতে পেরেছে যে, সে গর্ভে থাকাকালীন হাতুড়ে ডাক্তারের পরামর্শে অতি মাত্রায় ঔষধ সেবন করা ও টিকা না নেয়াই একমাত্র কারন।
বর্তমানে তার বযস ১২ বছর। সে মুখে বলতে পারেনা। রাতে তার পড়ার টেবিলের কোনে বসে বইগুলোর পাতা উল্টাচ্ছে আর ছবি দেখে দেখে,পড়ার সাথে সুর মিলিয়ে সে বেশ ক’টি ছড়া,কবিতা ও গল্পও সে শিখেছে। শেখ রহমান  অতিথি আপ্যায়নে সে খুব মজা পায়। তার লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে পরিবারের ও পাড়া প্রতিবেশী সকলেই মুগ্ধ। সে বাংলা- জার্মান সম্প্রীতি(বিজিএস) কর্তৃক বাস্তবায়িত টেকনাফ এপি প্রকল্পের শিখন শিখর কেন্দ্রটি স্থাপিত হওয়ার পর  এলাকায় শিশু জরীপের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী শেখ রহমান এর সন্ধান পায়। উক্ত কেন্দ্রের সিএমসি ও ভিডিসি’র কমিটির যৌথ প্রচেষ্টার ও পরিবারের আন্তরিকতার ফলে তাকে উক্ত কেন্দ্রে লেখাপড়ার জন্য ভর্তি করানো হয়।
শেখ রহমান তার সহপাঠীদের সাথে পড়তে পারবে জেনে মহা খুশী। প্রতিদিন সকাল নয়টা’র পূর্বেই তার আশেপাশের সহপাঠীরা বাড়িতে এসে তাকে নিয়ে আসে কেন্দ্রে । আবার ছুটি হলে তাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে আসে। সহপাঠী বন্ধুরা তাকে নিয়ে খেলাধূলা করে। পরিবারের ও সমাজের মধ্যে তার গ্রহনযোগ্যতা অনেক ভাল। পাড়া প্রতিবেশীরা কেন্দ্রে আসে তার পড়া লেখার খোঁজ খবর নেয় এবং তাকে উৎসাহ দেয়। শিক্ষিকারও আপ্রান চেষ্টা রয়েছে তার প্রতি।
তার মা ও বাবা অভিভাবক সভায় অংশগ্রহন করে সন্তানের প্রতি পিতা মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য জেনে শেখ রহমানের প্রতি তাদের যতœ আরও বেড়ে যায়। 
পরিবারের মধ্যে গ্রহনযোগ্যতা তার এখন অনেক ভাল। 
তার পরিবার এখন স্বপ্ন দেখে শেখ রহমান যাতে সমাজ ও পরিবারের উপর বোঝা না হয় যত কষ্টই হোক তার লেখাপড়া ও উন্নত চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাবে।